রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হচ্ছে লুটপাট ও সহিংসতা। কখনও বিক্ষোভের সুযোগে, কখনও ধর্মীয় বা রাজনৈতিক ইস্যুকে সামনে রেখে একশ্রেণির মানুষ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর, এমনকি চলন্ত যানবাহনেও হামলা ও লুটপাট চালিয়েছে। এই ধারাবাহিক সহিংসতায় প্রশাসনের কার্যকারিতা ও প্রস্তুতি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ মানুষের মাঝে। এরই মধ্যে গত সোমবার গাজার প্রতি সংহতির নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সহিংস ঘটনার তদন্তে সহায়ক কোনো তথ্য থাকলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানানোর আহ্বান জানিয়েছে সরকার।
জানা গেছে, গত সোমবার ৭ এপ্রিল ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ চলাকালে আন্তর্জাতিক ফাস্টফুড চেইন কেএফসি, পিৎজা হাট, বাটা, এমনকি দেশীয় দোকান ও রেস্তোরাঁয় হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে বিক্ষুব্ধ একদল দুর্বৃত্ত। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, কক্সবাজার ও খুলনাসহ দেশের অন্তত ১২টি শহরে এ ঘটনা ঘটেছে।
ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনার পর পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম এক বিবৃতিতে বলেছেন, আমাদের হাতে হামলাকারীদের ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় পুলিশ সর্বোচ্চ প্রস্তুত। এমন বার্তার পর সিলেট ও চট্টগ্রামে ভাঙচুর ও লুটপাটে জড়িত সন্দেহে এখন পর্যন্ত ৬০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত মঙ্গলবার পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া শাখা জানায়, হামলা ও ভাঙচুরে জড়িতদের বিরুদ্ধে দু’টি মামলা হয়েছে, আরও কয়েকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। পাশাপাশি জড়িতদের শনাক্ত করতে ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ ও গোয়েন্দা তৎপরতা চালানো হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে- ঘটনার সময় অনেক স্থানে তারা নিষ্ক্রিয় ছিল। কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও লুটপাটকারীদের ঠেকাতে দৃশ্যমান কোনও পদক্ষেপ নেয়নি।
এ বিষয়ে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. নুরুল হুদা বলেন, যেকোনও ধরনের জনআন্দোলনের মধ্যে চাঁদাবাজ, দুষ্কৃতকারী ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত চক্র ঢুকে পড়ে অরাজকতা তৈরি করে। প্রশাসনের উচিত ছিল গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আগে থেকেই এসব স্থান বিশেষ নজরদারিতে রাখা। পুলিশকে আরও সক্রিয় এবং জবাবদিহির মধ্যে রাখতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি ঠেকানো যায়।
অপরাধ বিশ্লেষক অধ্যাপক ডা. মো. ওমর ফারুক বলেন, বর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা কেবল একটি দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার জন্যই হুমকি নয় বরং বৈদেশিক বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্যও মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। কোনও আন্দোলনের আড়ালে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালানো এবং তা রোধে প্রশাসনের ব্যর্থতা আমাদের উদ্বেগের বিষয়। তিনি আরও বলেন, অপরাধ দমনে পুলিশের পাশাপাশি র্যাব ও অন্যান্য বিশেষায়িত বাহিনী মোতায়েন থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা ও রাজনৈতিক প্রভাব পরিস্থিতি জটিল করে তুলছে। একইসঙ্গে পাবলিকের জন্যই পুলিশ, সেই বিষয়টি মাথায় রেখে পুলিশের উচিত সাধারণ মানুষের পাসপেক্টিভ বুঝে, তাদের সঙ্গে কিছু বিষয়ে একাত্ম পোষণ করে কাজ করা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনই কঠোর আইনি ও সামাজিক পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
যেদিন এসব ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে, সেদিনই ঢাকায় চলছিল আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন ‘ইনভেস্টমেন্ট সামিট’। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ ধরনের অস্থিরতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মনে নেতিবাচক বার্তা পৌঁছে দিতে পারে। ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় গত সোমবার বাটা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘আমাদের একাধিক আউটলেটে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। এটি শুধু আমাদের ব্যবসার জন্য নয়, দেশের ভাবমূর্তির জন্যও ক্ষতিকর। আমরা দ্রুত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে কাজ করছি।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে সারা দেশে লুটপাট ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। তার-ই ধারাবাহিকতায় প্রায় প্রতিদিনই ঘটেছে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা। কখনও আন্দোলনের দোহাই দিয়ে বিভিন্ন আন্দোলন, ধর্মঘট বা বিক্ষোভের মধ্যে রাজধানী ও বিভিন্ন শহরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে একটি চক্র সংঘবদ্ধভাবে লুটপাটে মেতে উঠছে। এর পেছনে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া কিংবা প্রশাসনের দুর্বলতা কাজ করছে কিনা তা এখন তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে কারা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে এবং তাদের এজেন্ডা কী! নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, যে আন্দোলনের নামে ব্যবসায়ী, দোকানদার বা সাধারণ মানুষের ক্ষতি হয়, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার ও প্রশাসনের উচিত এখনই কঠোর বার্তা দিয়ে সব ধরনের অপরাধমূলক তৎপরতা দমন করা। তা না হলে এই সংস্কৃতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
এদিকে সরকারের দুর্বলতায় এমন পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হয়েছে জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতায় এসব ঘটনা ঘটেছে। আগেভাগেই ব্যবস্থা নেয়া হলে দেশের সুনাম এভাবে ক্ষুণ্ন হতো না। গত মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। অন্যদিকে পুলিশ প্রশাসন জানিয়েছে, লুটপাট ও ভাঙচুরের ঘটনায় যারা জড়িত তারা একটি রাজনৈতিক শ্রেণির মানুষ এবং সুবিধাবাদী চক্র। পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক আছে এবং এসব অপরাধীকে কোনও ছাড় দেয়া হবে না।
এদিকে মঙ্গলবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে গাজার প্রতি সংহতির নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সহিংস ঘটনার তদন্তে সহায়ক কোনো তথ্য থাকলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানানোর আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, এসব হামলা ও ভাঙচুর জননিরাপত্তা ও আইনের শাসনের জন্য হুমকিস্বরূপ। গত সোমবার দেশের বিভিন্ন স্থানে হওয়া সহিংসতার ঘটনায় পুলিশ দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত কমপক্ষে ৬০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে এবং সহিংসতার ঘটনায় চারটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনার তদন্ত চলছে এবং এই নিন্দনীয় কাজের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে আরও মামলা দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া ওই বিবৃতিতে জানানো হয়, পুলিশ গত সোমবার রাতেই অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে অভিযান চালিয়েছে। এছাড়া, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করার জন্য বিক্ষোভের সময় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজগুলো বিশ্লেষণ করছে। এই সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য দায়ী সবাইকে গ্রেফতার না করা পর্যন্ত এই অভিযান অব্যাহত থাকবে। তদন্তে সহায়তা করতে পারে এমন তথ্য থাকা যে কাউকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, যারা সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চায় তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা একসঙ্গে কাজের মাধ্যমেই নিশ্চিত করা সম্ভব।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

* দেশজুড়ে ভাঙচুর ও সহিংসতার ঘটনা তদন্তে তথ্য দেয়ার আহ্বান সরকারের * জড়িতদের শনাক্ত করতে ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ ও গোয়েন্দা তৎপরতা চালাচ্ছে
বিভিন্ন ইস্যুতে সংঘটিত হচ্ছে লুটপাট-সহিংসতা
- আপলোড সময় : ১০-০৪-২০২৫ ০১:০০:১৯ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১০-০৪-২০২৫ ০১:০০:১৯ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ